ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব ইশতিয়াক মু. আল আমিন

ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব
ইশতিয়াক মু. আল আমিন
আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতের অফুরন্ত ভান্ডার ঘিরে রেখেছে সৃষ্টিকূলকে। তার কোন নিয়ামই গুরুত্বের দিক থেকে কম নয়। তবে কিছু কিছু নিয়ামত প্রয়োজন ও অপরিহার্যতার বিচারে একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য স্রষ্টা তাদের যে ভাষার নেয়ামত দান করেছেন সেটাও এর অন্তর্ভুক্ত। ভাষাকে আল্লাহ তা’আলা তাঁর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, তার এক নিদর্শন হলো তোমাদের রং, ধরন এবং ভাষার ভিন্নতা (সূরা রুম: ২২) ভাষা ছাড়া মানবসভ্যতা অচল। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মানব সভ্যতাকে ছন্দময় গড়ে তোলার জন্য আল্লাহ তা’য়ালা আশরাফুল মাখলুকাত তথা মানুষকে দান করেছেন ভাষার নেয়ামত। আল্লাহ তা’য়ালা প্রথম মানব হযরত আদম আ.কে সৃষ্টির পর সর্বপ্রথম তাঁকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআন ইরশাদ হয়েছে , হযরত আদম আ. কে সৃষ্টি করার পর যত ভাষা দুনিয়াতে আছে সবকিছুর জ্ঞান তিনি তাকে দান করলেন। (সূরা বাকারা :১৩০) যুগে যুগে মানুষের হেদায়েতের জন্য তিনি যত নবী রাসুল পাঠিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষার যোগ্য দক্ষ করে পাঠিয়েছেন। যখন যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তা নবীদের মাতৃভাষার করেছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, আমি সব রাসূলকে তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি যাতে তারা আমার বাণী স্পষ্ট করে বোঝাতে পারে। (সূরা ইব্রাহীম:৪) যেমন: হযরত ঈসা (আঃ) এর জাতির মাতৃভাষা ‘সুবিয়ানি’ তাই এ ভাষায় তাঁর প্রতি ‘ইঞ্জিল’ অবতীর্ণ হয়। হযরত দাউদ (আঃ) এর গোত্রের মাতৃভাষা ছিল ইউনানী,তাই ‘যাবুর’ ইউনানী বা আরামাইক ভাষায় অবতীর্ণ হয়। হজরত মূসা (আ.)- এর সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল ইবরানি তাই সে ভাষায় তাওরাত কিতাব নাজিল করা হয়েছে।
সব মাতৃভাষা আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান। তাই কুরআনের ভাষা আরবি হওয়া সত্বেও পবিত্র কুরআন অন্যান্য ভাষার শব্দকে আরবি হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। যেমন- তোয়াহা, আল-ইয়াম, আত-তু‚র ইত্যাদি সুরইয়ানি ভাষার শব্দ। এর মাধ্যমে কুরআন সব ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে। (জালালউদ্দীন সুয়ুতী, আল-মুযহির)। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচারক দল গিয়েছেন। তাঁরা যে অঞ্চলে বা যে দেশে গিয়েছেন প্রথমে সেখানকার মানুষের ভাষা তাঁরা আত্মস্থ করেছেন এবং সেখানকার ভাষাতেই ইসলামের দিকে মানুষকে আহ্বান করেছেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম লোহিত সাগরের ওপারে অবস্থিত আবিসিনিয়ায় একদল সাহাবি প্রেরণ করেন। এই দল প্রেরণের পূর্বে হযরত জাফর ইবনে আবু তালিব রাদি আল্লাহু তায়ালা আন্হুকে আবিসিনিয়ার ভাষা আয়ত্ত করতে নির্দেশ দেন। অত্যন্ত মেধার অধিকারী হযরত জাফর ইবনে আবু তালিব (রা) কয়েকদিনের মধ্যে আবিসিনীয় ভাষা শিখে ফেলেন এবং আবিসিনিয়ার হিজরতকারী দলের সঙ্গে গমন করেন। আবিসিনিয়ায় পৌঁছে আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশীর দরবারে তিনি যে বক্তব্য তুলে ধরেন তা আবিসিনীয় ভাষায়। পারস্য দেশের একটি প্রতিনিধি দল প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁরা দেশে ফিরে যাবার প্রস্তুতিকালে কুরআন মজিদের কিছু অংশ তাঁদের মাতৃভাষা ফারসিতে অনুবাদ করে দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নির্দেশক্রমে হযরত সালমান ফারসী রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু সূরা ফাতিহাকে ফারসি ভাষায় তরজমা করে দেন। ফারসি ভাষাভাষী অঞ্চলে ইসলামের দ্রুত প্রসারের কারণ হিসেবে বলা হয় যে, ইসলামের কিতাবাদি ফারসি ভাষায় অনুবাদের ফলেই ত্বরিত ইসলাম সেখানে বিস্তৃত হয়। ইমাম আবু হানিফা রহ. মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার দেশবাসীর জন্য মাতৃভাষা ফারসি ভাষায় আল কুরআন অনুবাদ করার ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ ।হজরত আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি র. তাঁর এক ছাত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, “যদি হিন্দুস্থানে দ্বীনি খেদমত করতে চাও, তবে উর্দু ভাষায় যোগ্যতা অর্জন করো।” প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বলেন, “প্রত্যেকেরই শিক্ষার মাধ্যম তার মাতৃভাষা হওয়া উচিত। অপর ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষাদান অসম্পূর্ণ শিক্ষারই নামান্তর।” সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী র. বলেন, “কোনো দেশে দ্বীনি খেদমত করতে আগ্রহী ব্যক্তিকে সে দেশের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি বোধ পূর্ণ মাত্রায় অর্জন করতে হবে।” হুসাইন আহমদ মাদানী র. বলেন, “যতক্ষণ না তোমরা আপন ভাষা সাহিত্যের অঙ্গনে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা রাখবে, ততক্ষণ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।”
ভাষা আন্দোলন হয়েছে আজ প্রায় সত্তর বছর পূর্তি হতে চলছে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা জীবন দিয়েছিল সে উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছে? কোর্ট কাচারী থেকে শুরু করে সর্বস্তরে চলছে ইংরেজির প্রধান্য। ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্ররা কি আমাদের ভাষা শহিদদের নাম বলতে পারবে? ২১ ফেব্রুয়ারিকে কি আমরা ৮ফাল্গুন বলতে পেরেছি? আমাদের অফিস আদালতের সাইবোর্ড/নোটিশে এখনো শতশত ভুল বানানে ভরা কেন? সে উত্তর কি আমাদের বুদ্ধিজীবীরা খুঁজে দেখেছেন? এনটিআরসির বইয়ে শতশত বানান ভুল । রাষ্ট্র কি আমাদের সন্তানদের শুদ্ধ বাংলা উচ্চরন করাতে সক্ষম হয়েছে? অথচ আজ থেকে ৪হাজার বছর আগে হযরত ইব্রাহিম আ. বলেগিয়েছেন, “জ্ঞানীর জন্য উচিত তার ভাষা ও সাহিত্যের সংরক্ষণ করা, যুগসচেতন হওয়া ও স্বীয় কর্তব্যে সদা মগ্ন থাকা।” রাসুলুল্লাহ স. সারা জীবনে নিজ মাতৃভাষায় একটি অশুদ্ধ বাক্যও উচ্চারণ করেন নি; বরং অন্যদের মাতৃভাষা বিশুদ্ধভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এবং মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে জ্ঞানের পথ উন্মুক্ত করেছেন। আবার কখনও কখনও তিনি যুদ্ধবন্দীদের ভবিষ্যত প্রজন্ম সন্তান-সন্তুতিদের জন্য নিছক ভাষার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে, ভাষা শিক্ষা প্রদানের বিনিময়ে তাদেরকে মুক্তও করে দিয়েছেন (তাবাকাতে ইবন সা‘দ) রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে যেমন ভাষার প্রতি যত্নবান ছিলেন তেমনি অন্যদেরও যত্নবান হতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি কাউকে শব্দের ভুল প্রয়োগ বা ভাষার বিকৃতি করতে দেখলে তা শুধরে দিতেন। একবার এক সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে বললেন, ‘আ-আলিজু’। শব্দটির অর্থ ‘আমি কি প্রবেশ করব?’ আরবি ভাষায় এ অর্থে ব্যবহৃত হলেও তা অনুমতি প্রার্থনার জন্য যথেষ্ট নয়। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর গোলামকে বললেন, বাইরে গিয়ে তাকে একথা বলতে বল, ‘আসসালামু আলাইকুম! আ-আদখুলু?’ কারণ সে সুন্দরভাবে অনুমতি প্রার্থনা করেনি। (আল-আদাবুল মুফরাদ)। ইমাম মুসলিম (রহ.) তার সহি মুসলিমে ‘আল-আলফাজু মিনাল আদাব’ শিরোনামে অধ্যায় এনেছেন। সেখানে উপযুক্ত শব্দচয়ন সম্পর্কে হাদিস আনা হয়েছে। এ অধ্যায়ের হাদিসগুলোতে রাসুলুল্লাহ (সা.) ভুল শব্দ প্রয়োগের সংশোধনী এনেছেন এভাবে ‘আঙ্গুর’কে ‘কারম’ বলো না, ‘ইনাব’ কিংবা ‘হাবালাহ’ বলো। কাউকে ‘দাস’ না বলে ‘চাকর’ বলো, কারণ সবাই আল্লাহর দাস ও দাসী; মনিবকে ‘প্রভু’ বলো না, ‘সরদার’ বলো। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমাদের ভাষার রয়েছে এক রক্তমাখা ইতিহাস। তাই শুদ্ধ বাংলা শেখা ও শেখানো এবং বলায়-লেখায় শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা প্রয়োজন।
লেখক
শিক্ষক,সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী
Email:shrfdsalamin84@gmail.com