সফলকাম মুমিনের গল্প
জনৈক ব্যক্তি, রাসূলুল্লাহ(সা.) এর কাছে এসে বলল, “আমাকে তিলাওয়াত করা শিখান (অর্থাৎ সূরা শিখান), হে আল্লাহর রাসূল।” রাসূলুল্লাহ(সা.) বললেন, “তুমি সেই তিনটা সূরা তিলাওয়াত করো যেগুলো আলিফ-লাম-রা দিয়ে শুরু।”
লোকটা বলল, “আমার বয়স হয়েছে। আমার হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে আর জিহবা ভারী হয়ে গেছে।”
নবীজি (সা.) বললেন, “তাহলে ঐ তিনটা পড়ো যা হা-মীম দিয়ে শুরু।”
লোকটা একইভাবে বলল – এটাও কঠিন।
নবীজি (সা.) বললেন, “তবে সেই তিনটা পড়ো যেগুলো আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করে শুরু হয়।”
লোকটা একইভাবে বলল – এটাও কঠিন। সে যোগ করল, “হে রাসূলুল্লাহ(সা.), আমাকে এমন একটি সূরা শিখিয়ে দিন যেটা সবকিছু কাভার করে (comprehensive), আমি ওটা পড়ব।”
নবী (সা) তিলাওয়াত করলেন – “ইযা- যুলযিলাতিল আরদু যিলযা-লাহা ”। এভাবে তিনি সূরা যিলযাল এর শেষ পর্যন্ত পড়লেন।
লোকটা বলল, “সেই সত্তার কসম যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন, আমি এর সাথে সারাজীবনে আর কিছুই যোগ করব না (অর্থাৎ এই সূরায় যা আছে আমি শুধু তার উপরই আমল করব)” – এই বলে সে চলে গেল।
আল্লাহর রাসূল (সা) দুইবার বললেন, “ছোট মানুষটি সফল হয়েছে।”
– (আবু দাউদ ১৩৯৯, সাহিহ (আহমেদ শাকির), আব্দুল্লাহ ইবনে আমর(রা) হতে বর্ণিত)
হাদিসের শিক্ষা:
১) রাসূলুল্লাহ(সা) কতটা নন-জাজমেন্টাল ছিলেন তা লক্ষ্য করলে অবাক হতে হয়। লোকটা যতবারই রাসূলুল্লাহ(সা) কে বলেছে – এটা আমার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে, তিনি ততবারই তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দিয়েছেন।
একবারের জন্যও তিনি বলেন নাই – “এমনি এমনি বেহেস্তে যেতে চাও? এইটুকু করতে পারবা না?”, অথবা – “এটুক তো তোমার করতে পারা উচিত” – না, তিনি এরকম বলেন নাই।
তিনি লোকটিকে বিশ্বাস করেছেন। যখন সে বলছে সে পারবে না, সে কেন পারবে না, তার পারা উচিত কিনা, এটা করতে পারলে সে অনেক সাওয়াব হাসিল করতে পারতো – এসব কোন কথার মধ্যেই তিনি যাননি। আমরা মানুষের প্রতি যত নন-জাজমেনটাল হব – মানুষ তত আমাদের কাছে আসবে। অন্য মানুষকে আমরা যেন বিশ্বাস করি – ধর্মীয় কাজে এবং দৈনন্দিন কাজেও। চাপাচাপি, জোরাজুরি না করি, “তোমার এটা করা উচিত, ওটা করা উচিত” – যত কম বলা যায় তত ভাল।
২) কেউ যদি কঠিন নিয়ম পালন না করে সহজ নিয়ম পালন করে, তাকে নিয়ে উপহাস না করি। সূরা বাকারা পড়েও অনেকে মুনাফিক থেকে গেছে, আর শুধু সূরা যিলযাল পড়েও এই ব্যক্তি সফল হয়েছে।
৩) মনে করুন, আপনার বস এসে আপনাকে বলল – তোমাকে অমুক কাজটা করতে হবে। আপনি বললেন, স্যার আমি এটা করতে পারব না, অন্য একটা কাজ দেন। বস বললেন, আচ্ছা তাহলে ঐটা করো। আপনি কি এইবারও বলতে পারবেন – না স্যার, ঐটাও পারবো না। খুব সম্ভবত পারবেন না। ‘না’ বলতে আপনার মনে ভয় কাজ করবে। কারণ, আমরা আমাদের বসদের, নেতাদের ভয় পাই।
কিন্তু, আল্লাহর রাসূলের (সা) ব্যাপারটা দেখুন। তিনি তাঁর অনুসারীদের মনে এমন একটা মানসিক অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন – যে সবাই তাকে গভীরভাবে ভালবাসত, সম্মান করত, কিন্তু ভয়ে কম্পমান থাকত না। তারা নিঃসংকোচে রাসূলুল্লাহ(সা) এর কাছে সব বলতে পারত। তারা জানত – রাসূলুল্লাহ(সা) অন্যকে এই ব্যাপারে বলে বেড়াবেন না, তিনি জাজ করবেন না, ভুল কিছু বললে ক্ষমা করে দিবেন, এই কথার উপর ভিত্তি করে পরে প্রতিশোধ নিবেন না। এরকম গুনময় যে নেতা – তার অনুসরণ করতে কে না চায়?
৪) স্কলারেরা আলোচনা করেছেন – এত সূরা থাকলে রাসূলুল্লাহ(সা) লোকটাকে সূরা যিলযাল পড়তে বললেন কেন? কি এমন আছে এই সূরাতে যা ইসলামের আদ্যোপান্তকে কাভার করে? বেশীরভাগ স্কলার বলেছেন – এই সূরার মাহাত্ম্য এর শেষের দুই আয়াতে, যেখানে বিচার দিবস সম্পর্কে বলা হয়েছে –
“সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করলে সে তা দেখতে পাবে। এবং কেউ অনু পরিমাণ খারাপ কাজ করলেও তা দেখতে পাবে।” (সূরা যিলযাল ৭-৮)
বিচার দিবসের দিনে যেটাকে ভালো কাজ হিসাবে ধরা হবে সেটাই ভালো কাজ, আর সেদিন যেটাকে মন্দ কাজ হিসাবে ধরা হবে সেটাই মন্দ কাজ।
এই দুই আয়াতে অণু পরিমাণ হলেও ভালো কাজ করার কথা বলা হয়েছে আর অণু পরিমান মন্দ কাজেও না জড়ানোর কথা বলা হয়েছে – আর এটাই ইসলাম। আমরা বিশাল বিশাল কাজের কথা চিন্তা করে ঘাবড়ে যাই, হতাশ হয়ে পড়ি, হাল ছেড়ে দেই, শেষে আর কিছুই করি না। তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন ছোট কাজগুলোর কথা। রামাদানে অমুক ভাই দিনে এক পারা কুরআন পড়ে – আয় হায় আমি কি করলাম? ঠিক আছে, এক পারা না পারি – এক রুকু পড়ি, এক রুকু না পারি – একটা আয়াত তো পড়তে পারি। অমুকে তো ৫০ হাজার টাকা দান করে দিল, আচ্ছা আমি ৫০ হাজার না পারি ৫০০ টাকা করি, ৫০০ না পারলে ৫ টাকা তো পারি, তা-ও না পারলে মনে মনে আফসোস করি – ইশশ আমার অন্তরটা যদি ওর মতো সুন্দর হতো, আমিও যদি প্রাণ খুলে দান করতে পারতাম!
ছোট ভাল কাজ গুলোর গুরুত্ব মোটেও কম নয়। ছোট খারাপ কাজগুলোর ব্যাড-ইফেক্টও কম নয়। প্রতি মুহুর্তে মাথায় এটা রাখি, তাহলেই সফলতা আসবে।