‘চাঁদাবাজি’ মামলায় হাজিরা দিচ্ছেন তরুণ উদ্ভাবক জিসান
বিশেষ প্রতিনিধিঃ স্বপ্ন ছিলো বিজ্ঞানী হওয়ার। নিদেনপক্ষে প্রকৌশলী। যন্ত্রপাতি,কল-কব্জা ছিলো তার ভীষণ প্রিয়। কুড়িয়ে পাওয়া পুরনো যন্ত্রাংশ নিয়ে নাড়াচাড়া করে কত রাত যে ভোর হয়েছে! উদ্ভাবনের নেশায় নিমগ্ন জিসান হাওলাদার জীবনের নিশানা ঠিক করে ফেলেন কৈশোরেই। এসএসসি সম্পন্ন করে ভর্তি হন বরিশাল টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে।
পরে তিনি স্কলারশিপ নিয়ে চায়না চলে যান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। শুরু থেকে তার আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় মোটর ভেহিকেল। ক্লাসে,হলে রাত-দিন কাটে তার মোটর পার্টসের সঙ্গে। কোনো যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হলেই বরিশাল থেকে চলে আসতেন ঢাকার ধোলাইখাল। ২০১৫ সালের কথা। বিজ্ঞান মনষ্ক জিসানের সামনে আসে স্বীয় প্রতিভা প্রস্ফূটিত করার মোক্ষম সুযোগ।‘জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি(জাইকা)’ বাংলাদেশে আয়োজন করে ‘ইকো রান বাংলাদেশ-২০১৫’ প্রতিযোগিতার। ওই বছর ১৮ ডিসেম্বর প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বটি অনুষ্ঠিত হয় বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে। সেখানে স্থান পায় জিসান উদ্ভাবিত জ্বালানি সাশ্রয়ী গাড়ি। ‘বরিশাল রাইডার্স’ নামক গাড়িটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ১ লিটার ডিজেলে ১২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। পরিবেশবান্ধব এই গাড়ি জাইকার ব্যপক প্রশংসা কুড়ায়।
এর আগে ২০১৩ সালে ৩৪তম জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ এবং বিজ্ঞান মেলায় সিনিয়র গ্রুপে প্রথম স্থান লাভ করে জিসান উদ্ভাবিত ‘বরিশাল রাইডার্স’ প্রজেক্ট। সে সময় মোটর ভেহিক্যাল উদ্ভাবনের বহু সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার-প্রকাশ হয় জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে। অমিত সম্ভাবনাময় এ তরুণের স্বপ্ন ছিলো জাপানের বিখ্যাত মিতসুবিশি কোম্পানিতে চাকরি করার। এ লক্ষ্যে তিনি শেখেন জাপানি ও চায়নিজ ভাষাও। কিন্তু বিধি বাম। ২০২৩ সালে তিনি শিকার হন এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির। তিনি তখন ‘চঙকিং ইন্টারন্যাশনাল কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিআইসিও)’র পোল্ডার-৪৮,পটুয়াখালির মহিপুরে আলিপুর চায়না ক্যাম্পে চায়নিজদের দোভাষী হিসেবে কাজ করতেন। চায়না কোম্পানিতে ডিজেল সরবরাহ করতেন বরিশালের সাব-কন্ট্রাক্টর ‘মা এন্টারপ্রাইজ’র পরিচালক মো: মহসিন বিশ্বাস। তিনি ব্যারেলপ্রতি ১০ থেকে ১৫ লিটার ডিজেল পরিমাপে কম দিতেন। অথচ বিল নিতেন পুরোটারই।
উল্লেখ্য, মা-এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে জিসান হাওলাদারের ব্যবসায়িক এবং লেনদেনের সম্পর্ক ছিলো আগে থেকেই। তা সত্ত্বেও চায়না কোম্পানিকে প্রতারণামূলকভাবে ডিজেল কম দেয়ার ঘটনায় প্রায়ই জিসান হাওলাদারের সঙ্গে বিতন্ডা হতো মহসিন বিশ্বাসের। একপর্যায়ে চায়না কোম্পানি মা এন্টারপ্রাইজ থেকে ডিজেল কেনা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখে। সৃষ্ট সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে গতবছর ৮ মে ‘সিআইসিও’র আরেক সাব-কন্ট্রাক্টর খান কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং’র এ মালিক আইয়ুব আলী খানের মধ্যস্থতায় মহসিন বিশ্বাস জিসানকে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানান।
এ লক্ষ্যে দুপুর ২টার দিকে সরল বিশ্বাসে কুয়াকাটায় ‘হোটেল কুয়াকাটা গ্রান্ড অ্যান্ড রিসোর্ট’র রেস্টুরেন্টে যান জিসান। সেখানে উপস্থিত হন মহসিন বিশ্বাস, ইউসুফ হাওলাদার, হানিফ মোল্লা ও মহসিন বিশ্বাসের ম্যানেজার মো: হাসান। হাসান খাবারের অর্ডার দিয়ে জিসান-মহসিন আলাপ-আলোচনায় মনযোগ দেন। হঠাৎ সাদা পোশাকধারী ৬ ব্যক্তি এসে জিসানকে ঘিরে ফেলেন। তাদের মধ্য থেকে সাব-ইন্সপেক্টর সম্বিৎ রায় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি)র লোক পরিচয় দিয়ে প্রথমেই জিসানের ২টি মোবাইল সেট হাতিয়ে নেন। তিনি চিৎকার দেয়ার চেষ্টা করলে তারা তাকে মারধোর শুরু করে। এএসআই সাইদুল সবুজ রঙের একটি মোড়ানে শপিং ব্যাগ জিসানের প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দেন। মুহুর্তের মধ্যেই সেটি আবার বের করে সাইদুল বলতে থাকেন, ‘চাঁদার টাকা পেয়েছি!’ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সম্বিৎ রায় (বিপি নং-৮৪০৪১৪৩০০১) জিসানকে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে নিয়ে যায় হোটেলের নিচতলায় পুরনো রিসিপশনে। সেখানে ‘উদ্ধারকৃত’ কথিত ‘চাঁদার টাকা’র সিজার লিস্ট করা হয়। ওই টাকা জিসানের সামনে রেখে ভিডিও এবং ছবি তোলা হয়। সেখান থেকে একটি মাইক্রোবাসে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পটুয়াখালি জেলা ডিবি কার্যালয়ে। পরে মহসিন বিশ্বাস বাদী হয়ে দায়ের করা ‘চাঁদাবাজি’র মামলায় {নং-৭(৫)২০২৩} গ্রেফতার দেখিয়ে জিসান হাওলাদারকে চালান করে দেয়া হয় কোর্টে। রিমান্ড চাওয়া হয়। রিমান্ডে মারধোরের ভয় দেখিয়ে জিসানের বড় ভাই ও শ্বশুরের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় ৪০ হাজার টাকা। কলাপাড়া উপজেলার চৌকি আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আশীষ রায় জামিন নামঞ্জুর করে দণ্ডবিধির ৩৮৫/৩৮৬/৫০৬/১০৯ ধারায় জিসানকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।
বিনা অপরাধে ২ মাস ৮ দিন কারাভোগ করে হাইকোর্টের আদেশে গতবছর ১০ জুলাই জামিনে মুক্ত হন জিসান। পরে পুরো বিত্তান্ত তুলে ধরে নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে পুলিশ হেডকোয়াটারে আবেদন করেন। তার আবেদনে উপরোক্ত তথ্যের উল্লেখ রয়েছে। পুলিশ হেডকোয়াটার জিসানের অভিযোগটি গুরুত্বসহকারে নিয়ে তদন্তে পাঠায়। এতে ফল হয় হিতে বিপরীত। কিছুদূর এগোনোর পর কলাপাড়া সার্কেল এসপি বিমল কৃষ্ণ মল্লিকের টেবিলে গিয়ে রহস্যজনক কারণে ঘটনাকে ভিন্নখাতে নিয়ে যাওয়া হয। পরে অভিযোগটি নথিভুক্ত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে বিরূপ প্রভাব পড়ে জিসানের বিরুদ্ধে করা কথিত চাঁদাবাজির মামলার তদন্তে।
জিসানের অভিযোগ, এ মামলা সম্পূর্ণ মিথ্যা। মহসিন বিশ্বাস ডিবিকে পয়সা দিয়ে আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাসিয়েছেন। একই ভাবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকেও মোটা অংকের অর্থ দিয়ে একতরফা চার্জশিট করিয়েছে। এজাহারে যা উল্লেখ করা হয়েছে, চার্জশিটে সেটাই উল্লেখ করা হয়েছে। মহসিনের সাজানো সাক্ষীদের বক্তব্য এখানে গ্রহণ করা হয়েছে। ঘটনাস্থল ও সময় ভুল উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী আইয়ুব আলী খান এবং হানিফ মোল্লাকে পিবিআইয়ে ডাকা হলেও তাদের বক্তব্য চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী রাহাত খান বিদেশ চলে যাওয়ার অজুহাতে তার পরিবর্তে মহসিন বিশ্বাসের সাজানো সাক্ষীর সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এভাবে আমাকে ফাসানোর জন্য মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে গত ১৯ মার্চ একতরফা চার্জশিট দাখিল করেন পিবিআই,পটুয়াখালির সাব-ইন্সপেক্টর এইচ.এম.আব্দুর রউফ। এ মামলায় গত ৮ মে হাজিরা ছিলো আমার। পরবর্তী হাজিরার তারিখ ধার্য রাখা হয়েছে ২৮ মে।
মামলার তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় সাব-ইন্সপেক্টর আব্দুর রউফ টেলিফোনে বলেন,ইতিমধ্যেই মামলাটির চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এজহারে আসামি ছিলেন একজন। এজাহারের সত্যতা মেলায় একজনের বিরুদ্ধেই চার্জশিট দেয়া হয়েছে।
এদিকে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে ডিবি দিয়ে গ্রেফতার করানো, মামলা দায়ের এবং একতরফা চার্জশিট করানোর বিষয়ে কথা বলতে ‘মা এন্টারপ্রাইজ’র পরিচালক মো: মহসিন বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। তাকে এসএমএস পাঠানো হয়। এতে তার সাড়া মেলেনি।