ইভ্যালিকে অবসায়ন করে দেনা শোধের প্রস্তাব
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির মোট দেনার পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ অর্থ কোথায় গিয়েছে সে তথ্য এখনো স্পষ্ট নয়। এই অবস্থায় ক্রেতা-বিক্রেতার শত শত কোটি টাকার পাওনা বুঝিয়ে দিতে ব্যর্থ ইভ্যালিকে কোম্পানি আইন অনুযায়ী অবসায়ন বা বিলোপের মাধ্যমে দেনা পরিশোধের প্রস্তাব করেছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা।
আজ শনিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি আয়োজিত ‘ই-কমার্স খাতের চ্যালেঞ্জ: সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট ও করণীয়’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় এই প্রস্তাব করা হয়।
আলোচনা সভায় ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর অনিয়ম ঠেকাতে বিদ্যমান আইনই যথেষ্ঠ। প্রয়োজন শুধু সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সততা, সমন্বয় ও সক্ষমতা বাড়ানোর কথাও বলেছেন বক্তারা।
যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোম্পানি তার কাজকর্ম গুটিয়ে ফেলে, দায়-দেনার নিষ্পত্তি করে, সেটাই কোম্পানির অবসায়ন বা বিলোপসাধন। বাংলাদেশে ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২৩৪(১) ধারায় কোম্পানীর বিলোপসাধন সম্পর্কে বলা হয়েছে।
সিপিডির আলোচনায় ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম বলেন, আইনের অভাব নাই, নতুন আইনেরও দরকার নাই। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা যদি বাড়ানো যায় এবং সেই প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সততার সাথে কাজ করে তাহলে এ ধরনের অনিয়ম ঠেকানো যাবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) যেসব আইন আছে, তা দিয়ে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।’
ই-কমার্সের কয়েকটি কোম্পানির টাকা নিয়ে পণ্য না দেওয়ায় ভোক্তা অধিদপ্তরে প্রায় ১৭ হাজার অভিযোগ পড়ার তথ্য তুলে ধরে তানজিব বলেন, কিন্তু এতো বেশি অভিযোগ নিয়ে কাজ করার মতো জনবল ও দক্ষতা কোনটাই ওই প্রতিষ্ঠানের নেই। অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানও সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন বাংলাদেশ ফাইন্যানশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) নেতৃত্ব দিতে পারতো বলে মনে করেন আর্থিক খাতের শীর্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির এই আইনজীবী।
তিনি বলেন, সন্দেহজনক লেনদেনের ঘটনায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইভ্যালির লেনদেন একমাস বন্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু এরপর ওই নিষেধাজ্ঞা আর বাড়ানো হয়নি অথবা নিষেধাজ্ঞা বলবৎও রাখা হয়নি।
তানজিব বলেন, বিএফআইইউর ঘটনার পর আইনও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুটি সংস্থাকে ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু দুটি প্রতি প্রতিষ্ঠান দুই রকম প্রতিবেদন দিল। ফলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই ঘটনার বিস্তারিত তদন্তে যে রকম জ্ঞান ও দক্ষ লোকবল দরকার তা নেই। সুতরাং বিষয়টি এভাবেই ঘোলা হয়েছে। এখন জনগণের পাওনা টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন? অনেকে বলাবলি করছে, যে সরকারি অর্থায়ন থেকে জনগণের পাওনা মিটিয়ে দেওয়া হোক।’
এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ‘জনগণের করের টাকা সরকারের কাছে আমানত। একজনের লুটপাটের টাকা পরিশোধে আমি ট্যাক্স দিইনি- এটা সংবিধানবিরোধী। তাই এখন কোম্পানি আইন অনুযায়ী ওই কোম্পানিকে অবসায়ন করে যে অর্থ পাওয়া যায় তা দিয়ে পাওনা পরিশোধ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে যে লোকের ২০ হাজার টাকা পাওনা আছে তাকে এক হাজার টাকা দেওয়া সম্ভব হলে, তাকে ওইটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই করের টাকায় এই পাওনা পরিশোধ করা যাবে না।’
আলোচনায় বিডিজবস এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হাতে যেসব আইন আছে তা দিয়েই ই-কমার্স খাত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। কিন্তু তাদের লোকবল সেরকম লোকবল নেই। তবে নতুন করে ই কমার্সের জন্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আরোপ করা হলে, এই খাতের নতুন নতুন নিয়মকানুন বেঁধে দেওয়া হলে এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে।’
আলোচনায় ব্রাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আরএফ হোসাইন বলেন, ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জসহ বেশ কয়েকটি ই-কমার্স কোম্পানি দেশের অর্থনীতিতে অনেক বড় বিপদ সংকেত দিয়েছে। দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সবগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করেই এই খাত নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
তার কথায়, ‘ইভ্যালিসহ সম্প্রতি যা ঘটেছে তা সকল পক্ষের লোভের কারণেই হয়েছে। এখন জনগণের বিপুল পাওনা টাকা কোথায় আছে, তা খুঁজে বের করে যেটুকু পাওয়া যায়, তাই ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর ‘ডিজিটাল মনিটরিং’ দরকার। কিন্তু তা করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও জনবল সরকারের নেই। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতাও বড় সমস্যা।
এক গ্রাহকের করা মামলায় ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে সম্প্রতি গ্রাহকের করা প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার করে র্যাব।